শামীমা আক্তার রুমি, খাগড়াছড়ি:: খাগড়াছড়িতে অবৈধ ভাবে ইট তৈরির কাজ শুর। এসব ইটভাটায় জ্বলছে বনের কোঁচিকাঁচা গাছ। জেলার ৯টি উপজেলায় প্রায় ৩৫টি ইটভাটার ইট তৈরি ও ফসলী জমি থেকে স্কাভাটার দিয়ে ট্রাকে মাটি সংগ্রহ ও সরকারি নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করেই বনের মাঝে, লোকালয় এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশেই গড়ে তোলা হয়েছে পরিবেশ বিপর্যয়কারী এসব ভাটা। ভাটায় ব্যবহার করা হচ্ছে পাহাড় ও কৃষি জমির উর্বর মাটি। বন, পাহাড় ও জমির উর্বর মাটি উজাড়ের মাধ্যমে পরিবেশ ধ্বংসের প্রক্রিয়া চলমান থাকলেও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রশাসন ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
সূত্রে জানা যায়, খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় উপজেলায় সর্বাধিক ৯টি ইটভাটা রয়েছে। লক্ষ্মীছড়ি উপজেলায় কোনও ভাটা না থাকলে সীমান্তবর্তী চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি ও খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলার একাধিক ইটভাটা থাকার প্রভাব পড়ছে সেখানকার পরিবেশ ও স্থানীয় জনজীবনে। এছাড়া জেলার সদর উপজেলায় ৫টি (মেসার্স এ বি ব্রিকস, আরপি এস ব্রিকস, জে এন্ড এস ব্রিকস, এম আর বি, সেলিম ব্রাদার্স), দিঘীনালায় ২টি (এডিবি ব্রীকফিল্ড, কর্ণফুলী ব্রীকসসহ বেশ কয়েকটি) , পানছড়িতে ৩টি ( রুবেল এন্টারপ্রাইজ, সততা এন্টারপ্রাইজ, এমএসআর ব্রীকস ফিল্ড), গুইমারায় ৫টি ( ফোর স্টার ব্রীক ফিল্ড, মদিনা ব্রীক ফিল্ড, তারা ব্রীক ফিল্ড, এমএসপি, এসবিএম ব্রীক ফিল্ড), মানিকছড়িতে ২টি (সেলিম এন্ড ব্রাদার্স, থ্রী স্টার ব্রিকস ফিল্ড), মাটিরাঙ্গায় ৬টি( আরআরআর ব্রিকস, এ ৭৭ ব্রিকস, এবিএম ব্রিকস, বিআরএস ব্রিকস, ৬৬৬ ব্রিকস, ৫৫৫ ব্রিকস, ৩৩৩ব্রিকস, এইচ এন জে ব্রিকস, রুবেল এন্টারপ্রাইজ এমআরবি ব্রিকস, প্রীতি ব্রিকস ম্যানু, এস এন্ড বি ব্রিকস), মহালছড়িতে ৩টি (বিসমিল্লাহ ব্রিকফিল্ড, এ.এইচ.কে ব্রিকফিল্ড, মের্সাস ইউ কে এ ব্রিক ফিল্ড) ও রামগড়ে ৯টি (হাজেরা ব্রিকস, নুরুল ইসলাম ব্রিকস, নুরজাহান ব্রিকস, এন.এম. প্রিক ম্যানুফেকচারিং, আপন ব্রিকস ২, মেঘনা ব্রিকস-১, এমএসপি ব্রিকস) ইটভাটা রয়েছে। তার মধ্যে অধিকাংশ ইটভাটায় ইট তৈরির ও পোড়ানোর কাজ শুরু হয়েছে। তারা সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অবৈধ ভাবে বনের কাঠ কেটে ব্রিকফিল্ডে মজুদ করছে। এছাড়াও ফসলী জমি থেকে মাটি কেটে ব্রিকফিল্ডে ইট তৈরির কাজে ব্যবহার করছে। এরই ধারাবাহিকতায় গুইমারায় ৫টি ইটভাটার মধ্যে ৪টিতে অবৈধ ভাবে জ্বালানী কাঠ ব্যবহারের জন্য ২লক্ষ টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমান আদালতের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট রাজিব চৌধুরী। একইদিনে মাটিরাঙ্গা উপজেলা তবলছড়িতেও ১টি ইটভাটায় ১লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, ইটভাটাগুলোতে এসব জ্বালানি কাঠ যাচ্ছে সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন বন থেকে। ইটভাটায় গাছের ছোট ছোট ডালপালা বা পাতা ব্যবহার হয় না, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মোটা মোটা গাছ করাত দিয়ে কেটে ছোট ছোট টুকরা করে ইটভাটার চুল্লিতে পোড়ানো হয়।
পরিবেশ কর্মীদের অভিযোগ, এসব কাঠ সরবরাহে কয়েক কোটি গাছ কাটা হয়। আর এভাবে ইটভাটা চলমান থাকলে আগামী কয়েক বছরে খাগড়াছড়িতে বন বলতে কিছু থাকবে না বলে আশঙ্কা তাদের। বন না থাকলে বন্যপ্রাণী, পশু-পাখি ও কীট-পতঙ্গ হুমকিতে পড়বে, নষ্ট হবে পরিবেশের ভারসাম্য।
সচেতন মহল বলেন, জেলার প্রায় ৩৫ ইট ভাটায় গড়ে ৫০ কোটি টাকার জ্বালানি কাঠ পোড়ানো হয়। পরিসংখ্যান উল্লেখ করে তারা আরও বলেন, “কাঠ সরবরাহকারীরা প্রত্যেকে বছরে প্রতি মণ গাছ ৯০ থেকে ১শত টাকা হারে ইটভাটায় সরবরাহ করেন। একটি ইটভাটায় বছরে ৯০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা বা তারও বেশি টাকার কাঠ সরবরাহ করতে হয়। এসব কাঠ স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন ব্যক্তির থেকে ক্রয় করেন বলে জানান তারা।
এদিকে বনের কাঠ ইটভাটায় পোড়ানো বন্ধে টাস্কফোর্স করে অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে জানিয়েছেন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা। সম্প্রতি তিনি বলেন, ‘পার্বত্য এলাকায় বন বিভাগের অনুমোদন ছাড়া কোনও গাছ কাটা ও পরিবহন সর্ম্পূণ নিষিদ্ধ। জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নেতৃত্বে টাস্কফোর্সের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করে ইটভাটার অনিয়ম বন্ধ করা হবে।
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট ও জেলা প্রশাসক মো: নজরুল ইসলামের সাথে আইন লঙ্গন করে ইটভাটায় কাজ পরিচালনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক উপজেলা অবৈধ ইটভাটা বন্ধের আদেশ দেওয়া হয়েছে আদেশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর কোথায় লাইসেন্স বিহীন ইটপোড়ানো হচ্ছে অথবা ইট তৈরি হচ্ছে এমন অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
রামগড় উপজেলা নির্বাহী অফিসা মমতা আফরীন এর সাথে অবৈধ ভাবে জ্বালানী কাঠ ব্যবহার করে ইটভাটার কার্যক্রম পরিচালনার বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শিগ্রই মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
জেলা প্রশাসক জানান, ‘ইটভাটা মালিকেরা যদি প্রশাসনের নির্দেশনা না মানেন, তাহলে মোবাইলকোর্ট পরিচালনা করে ইটভাটা মালিকদের বিরূদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ ‘গত বছর বেআইনিভাবে ইটভাটা চালানোয় বিভিন্ন ভাটায় জরিমানা করা হয়েছে উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘পরিবেশ বিধ্বংসী কাজ করলে এবার কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
খাগড়াছড়ি জেলার বিভাগীয় বনকর্মকর্তা মোঃ ফরিদ মিয়ার সাথে ইটভাটায় অবৈধ ভাবে জ্বালানী কাঠ ব্যবহারের বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, জেলা প্রশাসকের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অবৈধ ইটভাটাগুলোতে শিগ্রই যৌথ অভিযান পরিচালনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
Leave a Reply